আগে কারো সাথে নতুন পরিচয় হলেই আমার লেখা বই উপহার দিতাম। এখন আর দিই না। কারণ কী? কারণ যাকে-তাকে বই দেওয়া উচিত নয়-আমি মনে করি। আমরা শিক্ষিত বলতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত মানুষকে বুঝি আর জ্ঞানী বলতে বুঝি সরকারি অফিসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরপ্রচলিত ধারণা থেকে বলছি। কিন্তু এই শিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বই পড়তে আগ্রহী নয়। অথবা অন্যের লেখালেখিকে তাঁরা নগন্য ভাবেন, অনেকেই নিজেকে বেশি যোগ্য ও জ্ঞানী ভাবেন। আমার নগন্য লেখকি চোখ ঐসব খুব সহজেই দেখতে পায়, তাই নিজের বই নিজের কাছেই রেখে দিই এখন।
একবার একজন কর্মকর্তাকে বইয়ের সৌজন্য কপি দিয়েছিলাম। তিনি বই সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না! আনমনে বই রেখে দিলেন ড্রয়ারে। আমি দেখলাম, ব্যথা পেলাম। প্রথম প্রতিজ্ঞা করলাম কাউকে বই দিবো না!
![]() |
কবি ও লেখক সুপ্রিয়া বিশ্বাস |
আরেকজন কর্মকর্তা বদলী হয়ে আসলেন বছর দেড়েক আগে। সৌজন্যস্বরূপ আমার বই সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমার বই পেয়ে বললেন, বুঝেছো সুপ্রিয়া, বই পড়া হয় না। অন্য বই দেখিয়ে বললেন, এই দেখো কতজন বই দিয়েছে,পড়া হয় না।
একটু হেসে বললাম, ওকে স্যার।
দ্বিতীয়বার প্রতিজ্ঞা করলাম, সেঁধে আর কাউকে কখনও বই দিবো না!
আমার মনে হলো, এদের জন্য যদি আমার একসেট বই না নিয়ে একটা বিছানার চাদর নিতাম, তাও বেশি খুশি হতেন। মনে হয় বইয়ের যেন কোন মূল্যই নেই। কিন্তু বই ছাপাতে একজন লেখকের যেমন শ্রম ব্যয় হয়, তেমনি অর্থও কম খরচ হয় না।
ন্যূনতম পারিশ্রমিক ও শুভেচ্ছা অন্তত একজন লেখক আশা করতেই পারেন।
তবে সবাই যে এমন তা কিন্তু নয়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার অহিন্দ্র কুমার মন্ডল স্যার ছিলেন ব্যতিক্রম একজন মানুষ। আমার লেখালিখি এবং বই সম্পর্কে ঊনি খুব ইতিবাচক ছিলেন। তিনি সবার কাছে আমার লেখালেখির উচ্ছসিত প্রশংসা করতেন। একদিন বললেন , সুপ্রিয়া আমি আপনার কবিতার বই পড়ি । খুব খুশি হলাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম স্যারের প্রতি।
কালুখালীতে একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন। জনাব শাহ্ মোহাম্মদ সজীব, তিনি এত বেশি সাংস্কৃতিকমনা ও সাহিত্যিকপ্রিয় যা, খুব প্রশংসার দাবিদার। একদিন আমাকে বললেন, সুপ্রিয়া, কালুখালীতে একটা সাহিত্য সম্মেলন করেন, আমি উপস্থিত থাকব। তার আগ্রহে কবিদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হলো , কিন্তু সেদিন আমার ট্রেনিং থাকায় উপস্থিত থাকতে পারিনি, তবুও আমি তাঁর আন্তরিকতার জন্য কৃতজ্ঞ।
অনেক পাঠক, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী অনলাইনে আমার বই সংগ্রহ করেছেন, আমাকে উৎসাহিত করেছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি।
এই তো সেদিন সিলেট থেকে কিরণময় পশি নামে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী কুরিয়ারের মাধ্যমে চা পাঠিয়ে দিয়েছেন, গত বছরও পাঠিয়েছিলেন। আমি জানিও না, হঠাৎ আমার বাড়িতে চায়ের পার্সেল নিয়ে হাজির ডেলিভারিম্যান।
কিরনময় পশিকে বললাম, কেন পাঠিয়েছেন কষ্ট করে চা?
তিনি বললেন,বই পাওয়ার জন্য তিনি আমাকে চা পাঠিয়েছেন। অবশ্যই এমন পাঠকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
Nill shamim ভাই প্রতিবছর আমার বই নেন। বন্ধু বিপুল সাহা, ইন্দ্রজিত, অম্লান অভি, তুষার কান্তি, মুনতাসির রানা, সাবেরা আতিকসহ অনেক বন্ধু বান্ধবী আমার বইয়ের নিয়মিত সংগ্রাহক। এরকম আরো অনেকেই আছেন, আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
“সত্যিকার অর্থে বই নাড়াচাড়া করে বইয়ের মধ্যে কী আছে, সেটা দেখে বই কিনছে খুব কম পাঠক। আর বন্ধুবান্ধব? এমন বন্ধু খুব কম। তারা তো মুখে মুখে বন্ধুত্ব দেখিয়ে গ্রুপ খুলে বিভিন্ন ধান্দাবাজির জন্য বসে আছে। তারা স্বার্থান্বেষী। কারো কারো পিছনে বিভিন্ন ধান্দাবাজির কারণে তৈলবাজি করছে। কিছু আত্মীয় তো দেখেও না দেখার ভান করে ।”
বই বিক্রি আজকাল পরিচিতি ও ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। সত্যিকার অর্থে বই নাড়াচাড়া করে বইয়ের মধ্যে কী আছে, সেটা দেখে বই কিনছে খুব কম পাঠক। আর বন্ধুবান্ধব? এমন বন্ধু খুব কম। তারা তো মুখে মুখে বন্ধুত্ব দেখিয়ে গ্রুপ খুলে বিভিন্ন ধান্দাবাজির জন্য বসে আছে। তারা স্বার্থান্বেষী। কারো কারো পিছনে বিভিন্ন ধান্দাবাজির কারণে তৈলবাজি করছে। কিছু আত্মীয় তো দেখেও না দেখার ভান করে ।আর কিছু প্রতিবেশি তো ভাবে ওর বই কিনলে ও বুঝি রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাবে।ওর বই কিনো না ,ওর নাম মুখে এনো না। আবার কোন কোন কলিগ তো মনে করে কাম নাই বই লেখে।আর কেউ কেউ বা মেলায় গিয়ে একখান বই নিয়ে ছবি তুলেই ভালোবাসার দায়মুক্তি মনে করে। প্রকাশক দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলে,ম্যাম সে তো ছবি তুলেই পালিয়েছে। আর এক শ্রেণির লোক আছে, অনেক অনেক লোক আছে কত স্বার্থ উদ্ধার করে ,অথচ লেখকের স্বার্থ কেউ দেখে না।
হ্যাঁ , কিছু বই কি তাই বলে বিক্রি হচ্ছে না? হচ্ছে। নিতান্তই যদি কেউ লিখতে চান সাজুগুজুর বই লিখুন, অথবা রান্নাবান্নার বই লিখলেও চলবে। তবে কবিতার বই লিখলে সেটার কদর খুব একটা হয় না।
তাই বলে কি কবিতা লিখবেন না কবি? কবিতার বই ছাপা হবে না?
যদি সাহস করে ছাপিয়েই ফেলেন কোন কবি তবে শুভাকাঙ্ক্ষীরা কবির পাশে থাকুন, অন্তত কবি সাহস পাবেন।
বাংলার সকল কবির লেখা সমাদৃত হোক এই প্রত্যাশা রাখছি।
3 মন্তব্যসমূহ
চমৎকার লেখা। লেখায় লেখকের আত্মোপলব্ধি অত্যন্ত সহজ ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। আমরা যারা বই উপহার পেয়ে লেখকের অবদানকে মনে রাখি না, তারা সত্যিই অত্যন্ত কৃপণ। লেখকের জন্য শুভ কামনা রইল।
উত্তরমুছুনআপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর লিখেছেন।আপনি সব সময় লেখকের পাশে থাকেন,এটা অত্যন্ত বড় মনের পরিচায়ক। আপনার আন্তরিকতার জন্য অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।
উত্তরমুছুননিশ্চয় অসাধারণ লেখা এটি। শুভেচ্ছা।
মুছুন