বেহাগ ও বসন্ত দিনের গল্প

বেহাগ ও বসন্ত দিনের গল্প

Size
Price:

Read more »




প্রথম গল্পটি থেকে কিছুটা পড়ে দেখুন :

বেহাগ ও বসন্ত দিনের গল্প
শাহনাজ শারমিন

কলিং বেলটা চাপতেই ছোট চাচা দরজা খুলে দিয়ে অভিমানী সুরে  বলল, কয়টা বাজে দেখতো খোকা। আর কত জ্বালাবি এই বুড়ো চাচা-চাচীকে। তুই দেরিতে বাসায় ফিরলে আমাদের বুঝি তোর জন্য চিন্তা হয় না? মৃদু হেসে মাসুদ জবাব দিলো, চাচা মনটা খুব খারাপ, তাই অফিস শেষে একটু হাঁটাহাটি করে এলাম। চাচী কি ঘুমিয়ে পড়েছেন চাচা?
হুম ঘুমিয়েছেন, তবে খুব রেগে আছেন তোর ওপর। ফ্রেশ হয়ে আয় বাবা, আমি তোকে খেতে দিচ্ছি।
মাসুদ বলল, এখন আর কিছু খাবো না। তবে একটু কফি খাবো। তুমি শুয়ে পড়ো, আমি নিজেই কফি বানিয়ে নেবো।
কী যে বলিস খোকা, তুই কি কফি বানাতে পারিস নাকি! ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি করে আনছি। 
মাসুদ ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসল। বেলকনি বললে ভুল হবে, ওর বেড রুমের সাথে বিশাল বড় খোলা ছাদ, বেলকনির মতোই। ছাদের মধ্যে হরেক রকমের ফুলÑদোলনচাঁপা, হাসনাহেনা, গন্ধরাজ। এ ছাড়াও মনমাতনো বাহারি রঙের বিদেশি কিছু ফুলের গাছও আছে। তাছাড়াও বেশ কয়েকটা ফলের গাছ আছে ছাদ বাগানটিতে। মাসুদ ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসলো। চাচা ধূমায়িত এক মগ কফি এনে টেবিলের উপর রাখলো।  স্নেহের হাতটা মাসুদের মাথায় রেখে বলল, বাবা কফি খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরিস। এভাবে আর নিজেকে কষ্ট দিস না।  চাচা রুমে চলে গেলেন।
কু-লী পাকিয়ে কফির ধোঁয়া বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে।  মাসুদ আনমনে ভাবতে থাকে সেই সুবর্ণপুর গ্রামের শিশিরভেজা  মেঠোপথ, জংলী ফুলের গন্ধ, হাজার পাখির কলকাকলি, রাখালের বাঁশির সুর, মা-বাবান স্নেহের পরশ, ভাই বোনদের আদরমাখা দুষ্টমিÑআর কত কি! আর বেলা? হ্যাঁ বেলাÑমাসুদের জীবনে প্রথম আসা সেই মেয়েটির কথা।  
মেয়েটির কাজল কালো ডাগর  দুটি চোখ। গোলাপ রাঙা ঠোঁট। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকত মিষ্টি দুষ্টু হাসি। গায়ের রঙ ছিল কাঁচা হলুদের মতো। ছিপছিপে পাতলা গড়ন। হঠাৎ দেখলে মনে হতো এ যেন স্বর্গের অপ্সরী। বেলা  চঞ্চলা হরিণীর মতো ঘুরে বেড়াত পাড়াময়। 
মাসুদের বাবা ফজল মিয়া দরিদ্র কৃষক। নিজের বাড়ি ছাড়া আর কোনো জায়গা-জমি নাই তার। পাঁচ সন্তানÑদুই মেয়ে, তিন  ছেলে।  বড় দুই মেয়েকে বিয়ে  দিয়েছেন অনেক আগে। মাসুদ ভাইদের মধ্যে বড়। অভাবের সংসারে ওরা তিন ভাই ছিল খুব মেধাবী। অন্যের বাড়িতে দিনমজুর খেটে তিন ভাই  পড়াশোনা করে।  মা জমিলা খাতুন ছেলেদের পরের বাড়িতে হাড়ভাংগা খাটুনির পর রাত জেগে পড়াশোনা করতে দেখে আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদেন। 
সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ। বিকেল বেলা  মা মাসুদকে ডেকে বললেন, বাবা মাসুদ, আকাশটা মেঘাচ্ছন্নÑবৃষ্টি নামতে পারে।  আমি গরুকে খাবার দিচ্ছি, তুই হাঁসগুলোকে শামুক কেটে দে।
মাসুদ মায়ের কথা মতো হাঁসগুলোকে শামুক খাওয়াচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো পেছনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।  পিছন ফিরে তাকিয়ে মাসুদ বেলাকে দেখে বলে কী জন্য এই বৃষ্টির বিকেলে এলে বেলা? বেলা একগাল দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, তোমাকে দেখতে এসেছি। তারপর আরো জোরে খলখল করে  হেসে মাসুদের হাত থেকে ছেঁচনিটা কেড়ে নিলো। ‘তুমি সরো মাসুদ ভাই, আমি হাঁসগুলোকে খাওয়াচ্ছি। এসব কাজ মেয়েদের, তুমি কেন করছ।’ বেলা বলল।
‘গরীব মানুষের কাজ আবার ছেলে-মেয়ে হয় নাকি! অভাবের সংসারে সবই করতে হয়। তুমি ওঠো বেলা, তোমার হাত দিয়ে গন্ধ আসবে।  তুমি  ধনীর দুলালী, তোমাকে এসব মানায় না। শামুকের নোংরা গন্ধ তুমি সহ্য করতে পারবে না।’ মাসুদ বলে।
 বেলা একটুও নড়ল না। বলল, ‘খুব পারব। সরো তুমি!’ মাসুদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো বেলা। মাসুদ একটু দূরে সরে গিয়ে বেলার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারল না কিছুতেই। কী অপরূপ মুখখানি! এই পরন্ত বিকেলের রৌদ্র-মেঘের লুকোচুরি খেলায় ওকে দারুণ মায়াবী লাগছে। মনে হচ্ছে যেন সদ্য ফোঁটা সন্ধ্যা মালতী। বেলা  কানের পাশে বুনো ফুল খুব যতœ করে ক্লিপ দিয়ে আঁটকে দিয়েছে। লম্বা বিনুনি পিঠে ঝুলছে। প্রিন্টের শাড়ি পরেছে বেলা। শাড়ি পরা দেখে মাসুদ দুষ্টুমি করে  বলে, ‘শাড়ি পরেছ কেন, তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে নাকি?’
 বেলা ঘাড় কাত করে মাসুদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুম বিয়ে কী করে করব;  যাকে বিয়ে করব বলে ভাবছি সেই তো পছন্দ করে না একটুও।’
কথা আর বেশি এগুলো না।  মাসুদের মা এসে বললেন, কী রে মা বেলা, এই অবেলায় কেন এসেছিস আর এসব কী করছিস তুই!  উঠে আয় বলেই জোর করে  বেলাকে উঠিয়ে নিয়ে হাত ধুইয়ে দিলেন মা। ‘বেলা মা কি মনে করে এসেছিস বললি নাতো? মা জিজ্ঞেস করলে বেলা বললÑ‘চাচী, মা পাঠায়ছে হাঁসের ডিম নেয়ার জন্য।  যতগুলো আছে সব দিতে বলছে।’ মা আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘এই অবেলায় কেন তোকে পাঠালো! চারিদিকে মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামতে পারে।  খবর পাঠালেই তো আমি ডিম দিয়ে আসতাম।’ মা ডিম আনতে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন।
মাসুদ বলল, মা ঠিকই বলেছেন বেলা। তুমি এসে ঠিক করোনি। আজ দুপুর থেকেই বৃষ্টি। একটু থেমেছিল কিন্তু মেঘের ঘোর এখনো কাটেনি। মাসুদের কথা শেষ না হতেই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। এদিকে সন্ধ্যা শেষ হয়ে বেশ খানিকটা রাত হয়ে গেলো, তবুও বৃষ্টি থামছে না। মাসুদ বেলাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই অবহেলায় কেন এলে বেলা, ডিম নিতেই না কি অন্য কোনো কারণ আছে?’
বেলা দূরে কোথাও উদাস হয়ে তাকিয়ে বলল,  ‘আজ তোমাকে কলেজে যেতে-আসতে দেখিনি, তাই...। তুমি জানো না, তোমাকে না দেখে থাকতে পারি না!
বেলার কথা শুনে চমকে ওঠে মাসুদ। কিছু না বলে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে বেলাকে। বেলা তখন লজ্জাবতীর মতো গুটিয়ে যায় ভিতরে ভিতরে।
বৃষ্টি থামতে খানিকটা রাত হলো। বৃষ্টি থামলেও আকাশে ঘন মেঘের কারণে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মা মাসুদকে বললেন, ‘মাসুদ তুই  বেলাকে পৌঁছে দিয়ে আয়। মাসুদ মাথা নত করে বলে, ‘আমি চাইতে পারব না।’  মা বুঝতে পেরে বলেন, ‘ঠিক আছে তোর বলতে হবে না।  তোকে দেখলেই বেলার মা টাকা দিয়ে দিবেন।’


0 Reviews


যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *